প্রকাশিত: ০৪/০৪/২০১৯ ৯:২৯ এএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার কারণে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) খাদ্য নিরাপত্তাহীন দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।

গত ২ এপ্রিল প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস: জয়েন্ট অ্যানালাইসিস ফর বেটার ডিসিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এফএও বলছে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চারটি দেশে প্রায় ১ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ এর মদ্যে অন্যতম। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা এ অঞ্চলের বাকি তিনটি দেশ মিয়ানমার, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান।

সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণ মূলত কক্সবাজারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এখানকার ১৫ লাখ মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা বলছে, স্থানীয় ও রোহিঙ্গা মিলে জেলার ১৩ লাখ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে, যাদের খাদ্য সহযোগিতা প্রয়োজন। এসব মানুষের কারণে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়েছে।

বাংলাদেশে সাড়ে তিন কোটি টন ছাড়িয়েছে চালের উৎপাদন। ভুট্টা উৎপাদন ছাড়িয়েছে ২৭ লাখ টন। আবহাওয়াগত কারণে গমের পাশাপাশি এক কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদন হচ্ছে দেশে। সবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনেও সাফল্য এসেছে। সব মিলিয়ে দানাদার খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এ অর্জন ম্লান হচ্ছে কক্সবাজারে আশ্রিত ১২ লাখ রোহিঙ্গার চাপে।

যৌক্তিক কারণে হয়তো বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীন দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে বলে মন্তব্য করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, দেশে আশ্রয় নেয়া ১০-১১ লাখ রোহিঙ্গার খাদ্য চাহিদা মেটাতে চাপ তৈরি হতেই পারে।

এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে রোহিঙ্গা সংকট আমাদের বিপদের সংকেত দিচ্ছে। এ সংকট আমাদের পেছনের দিকে টানছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেশের ভাবমূর্তিকে হয়তো চাপে ফেলবে না, তবে সামনের দিনে পরিস্থিতি মোকাবেলায় আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

এজন্য খাদ্যশস্য উৎপাদন যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে দায় রয়েছে, সেটি নিয়েও কাজ করতে হবে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যাতে নিরাপদ ও টেকসইভাবে হয়, সে বিষয়ে কূটনৈতিক পদক্ষেপ জোরদার করতে হবে।

নতুন করে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর কক্সবাজারে এ জনগোষ্ঠীর মানুষ স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে গেছে। কক্সবাজারে প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই এখন রোহিঙ্গা।

এফএওর তথ্যমতে, রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে স্থানীয়রাও।

২০১৮ সালে কক্সবাজারে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিনাতিপাত করেছে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ। খাদ্য নিরাপত্তা সূচকের বিভিন্ন নির্দেশকের গতিপ্রকৃতি বলছে, ২০১৭ সালের রিফিউজি ইনফ্লাক্স ইমার্জেন্সি ভালনারেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট (আরইভিএ) বেজলাইনের তুলনায় এ সময় রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মে-জুন ও আগস্ট-সেপ্টেম্বর মনিটরিং রাউন্ডেও বিষয়টি উঠে এসেছে। মূলত নিয়মিত ও কার্যকরভাবে খাদ্য সহায়তা দিতে পারার কারণেই এ সময় রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেছে। উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী মূলত খাদ্য সহায়তার ওপরই প্রায় শতভাগ নির্ভরশীল।

২০১৭ সালের আরইভিএ সমীক্ষা এবং ২০১৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মনিটরিং রাউন্ডের তথ্যের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাস্তুচ্যুত খানাগুলোর ৯১ শতাংশেরই নিজেদের খাদ্যগ্রহণের মাত্রা ধরে রাখা অথবা এর উন্নয়ন ঘটানোর সামর্থ্য রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও অবনতি হয়েছে স্থানীয়দের। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা এ সময় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে। ২০১৭ সালে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পুওর বা বর্ডার লাইন ফুড কনজাম্পশন সীমায় অবস্থানরত স্থানীয় জনগোষ্ঠী ছিল ৩১ শতাংশ। ২০১৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ শতাংশে। চলতি বছরজুড়েই এ অবস্থা বিদ্যমান থাকবে।

জেলায় খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি কেন খারাপ হচ্ছে, তার কারণও ব্যাখ্যা করেছে জাতিসংঘের সংস্থাটি। তারা বলছে, এমনিতেই দরিদ্র ও ভঙ্গুর জেলাগুলোর অন্যতম কক্সবাজার। রোহিঙ্গা বসতির কারণে স্থানীয় দরিদ্র জনগণের অনেকেই কৃষিজমিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। বন ও মাছ ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করত, এ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারাও। বাধ্য হয়ে অনেককেই দিনমজুরের কাজ করতে হচ্ছে।

কিন্তু রোহিঙ্গাদের সস্তা শ্রমের কারণে দিনমজুরের কাজের সুযোগও স্থানীয়রা আগের মতো পাচ্ছে না। তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে দৈনিক মজুরিও কমে গেছে। বিপরীতে বাড়তি জনসংখ্যার চাপে বেড়ে গেছে খাদ্যমূল্য, যা সেখানকার দরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

খাদ্য ঘাটতির চেয়ে ক্রয় সক্ষমতায় পিছিয়ে থাকার কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা চরম আকার ধারণ করছে বলে মনে করেন সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল।

তিনি বলেন, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা থেকে শুরু করে দেশের হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে এ পরিস্থিতি বিরাজমান। এ প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা নতুন কিছু নয়। কেননা এখনো দেশে বিরাটসংখ্যক মানুষের পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব রয়েছে। এ থেকে উত্তরণে খাদ্যোৎপাদন যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি বাড়াতে হবে পুষ্টিকর খাবারের সরবরাহও। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযানের পর রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসতে থাকে। নতুন করে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয় ৭ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। এর সঙ্গে আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করা রোহিঙ্গার সংখ্যা হিসাবে নিলে এ জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় স্থানীয়দের তিন গুণ। বিপুলসংখ্যক এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকায় বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে বলে জানিয়েছে এফএও।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এসব রোহিঙ্গাকে খাওয়ানোর ক্ষেত্রে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে ডব্লিউএফপি। যদিও বিভিন্ন সময় গবেষণায় উঠে এসেছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা তীব্র পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এছাড়া গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী নারীর মধ্যে প্রকট পুষ্টিহীনতা শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের খাদ্যে বিশেষ কোনো বৈচিত্র্য থাকছে না। এতে অপুষ্টিতে ভুগছে অনেকে।

পাঠকের মতামত

পবিত্র ঈদুল ফিতর আজ

‘ঈদ এসেছে দুনিয়াতে শিরনি বেহেশতী/দুষমনে আজ গলায় গলায় পাতালো ভাই দোস্তি’- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ...